গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি: সমাধান না ভোগান্তি?

  © টিডিসি সম্পাদিত

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে গুচ্ছ পদ্ধতির প্রবর্তন একদিকে যেমন নতুনত্বের ছোঁয়া এনেছে, অন্যদিকে তা শিক্ষার্থীদের এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একাধিক সমস্যার জন্ম দিয়েছে। গুচ্ছ পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য ছিল ভর্তির প্রক্রিয়া সহজতর করা, শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমানো এবং একটি সমন্বিত ব্যবস্থার মাধ্যমে ভর্তির মান নিশ্চিত করা। তবে এর বাস্তবায়নে কিছু ত্রুটি ও দুর্বলতা দেখা দিয়েছে, যা মূল লক্ষ্যকে বাধাগ্রস্ত করছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত ছিল রাজনৈতিক, যা শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করার পরিবর্তে তার গুণগত মানের অবনতি ঘটাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে হলে নিরপেক্ষ এবং স্বতন্ত্র প্রক্রিয়ার প্রয়োজন, যেখানে রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা পাওয়ার অভিলাষ নয় বরং প্রভাব মুক্ত একটি স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থা কার্যকর থাকবে। কিন্তু গুচ্ছ পদ্ধতি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রভাব কাজ করেছে, যা ভর্তি পরীক্ষার গুণগত মান বজায় রাখতে সক্ষম হয়নি। রাজনীতিক সিদ্ধান্তের প্রভাবে ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতিতে মান নিয়ন্ত্রণের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে, যার ফলে শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা, গুণগত মানহীনতা এবং বিভিন্ন প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।

শিক্ষার্থীরা এখন আগের চেয়ে অধিক পরিমাণে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে, কারণ তাদের ভর্তির জন্য নির্ধারিত সময়সীমা লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং বিভিন্ন কারণে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হতে অনেক বিলম্বিত হচ্ছে। এর ফলে ক্লাস শুরু হওয়া দেরি হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবনের শুরুতেই অপ্রয়োজনীয় সময় নষ্ট করছে। এছাড়া গুচ্ছ পদ্ধতিতে মেধা তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ থাকায় দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং শিক্ষার্থীরা যোগ্যতার ভিত্তিতে যথাযথ মূল্যায়ন পাচ্ছে না।

গুচ্ছ পদ্ধতির মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়া চালু করা হলেও এতে বেশকিছু গুরুতর সমস্যা দেখা দিয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি বৃদ্ধি করেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্যও নানা অসুবিধার সৃষ্টি করেছে। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

আরও পড়ুন: ভর্তি পরীক্ষার তিন গুচ্ছে ভাঙনের গুঞ্জন, যা বলছেন ইউজিসি চেয়ারম্যান

প্রথমত, গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীরগতিতে সম্পন্ন হওয়ায় শিক্ষার্থীরা সময়মতো ভর্তি হতে পারে না। এই দীর্ঘসূত্রতার ফলে শিক্ষাবর্ষের নির্ধারিত সময়ে ক্লাস শুরু করা সম্ভব হয় না, যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের শুরুতেই বাধার সৃষ্টি করে।

দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় মেধা তালিকার ওপর নির্ভরশীলতার কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে স্থানীয় বা বিভাগীয় পর্যায়ে মেধাবী শিক্ষার্থী আকর্ষণের সুযোগ কমে যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। 

তৃতীয়ত, গুচ্ছ পদ্ধতিতে অংশগ্রহণের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের নিজস্ব চাহিদা ও মানের ভিত্তিতে ভর্তি প্রক্রিয়পরিচালনার স্বাধীনতা হারিয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীর গুণগত মান নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। 

চতুর্থত, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ভর্তি প্রক্রিয়ায় কার্যকর সমন্বয়ের অভাবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। একই সময়ে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ধাপে ভর্তি কার্যক্রম চলমান থাকায় এই সমন্বয়হীনতা ভর্তির প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে।

পঞ্চমত, গুচ্ছ পদ্ধতির কারণে শিক্ষাবর্ষের নির্ধারিত সময়ে ক্লাস শুরুতে বিলম্ব হয়। ভর্তি কার্যক্রম চলমান থাকার সময়েই ক্লাস শুরু হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মনোযোগ বাধাগ্রস্ত হয় এবং শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে। অবশেষে, গুচ্ছ পদ্ধতিতে মেধা তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ থাকায় দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে মেধা তালিকায় ভুল বা দুইবার প্রকাশের মতো ঘটনা ঘটছে, যা ভর্তি প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করছে। এই সমস্যাগুলো বিবেচনায় রেখে বলা যায়, গুচ্ছ পদ্ধতির মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত না হওয়ায় শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

গুচ্ছ পদ্ধতির সমর্থনে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর ভোগান্তি হ্রাসের যুক্তি দেওয়া হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি জেলা শহরেই বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এবং ঢাকা, রাজশাহী, ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বিভাগীয় পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের ভ্রমণজনিত ভোগান্তি অনেকটাই কমিয়ে এনেছে। 

উন্নত বিশ্বে ভর্তি প্রক্রিয়ায় শুধু অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর ভোগান্তি বিবেচনায় নেওয়া হয় না; বরং ভর্তির ক্ষেত্রে গুণগতমান নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীর একাডেমিক দক্ষতা, সামগ্রিক মানসিক প্রস্তুতি, এবং সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এভাবে শিক্ষার্থী নির্বাচনে গুণগত মান অগ্রাধিকার পায়, যা শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক শিক্ষার মান উন্নত করতে সহায়তা করে।
গুচ্ছ পদ্ধতির নেতিবাচক প্রভাব ও সীমাবদ্ধতাগুলো থেকে উত্তরণে আগের মতো বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ভর্তি পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তন করা উচিত। এতে করে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজস্ব নীতিমালা ও মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষার্থী বাছাই করতে পারবে, যা শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে সহায়তা করবে। 

আরও পড়ুন: মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার তারিখ চূড়ান্ত, ৩৬ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন গুচ্ছ কি থাকবে?

একইসাথে, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়ায় স্বতন্ত্রতা ও স্বাধীনতা বজায় রাখা হবে, যা ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমিয়ে উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। দুর্নীতির সুযোগ রোধে মেধা তালিকা প্রণয়নে স্বচ্ছতা এবং প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো উচিত। তালিকা প্রণয়নে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যাতে মেধার ভিত্তিতে যোগ্য শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পায়।

নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাস শুরু করার জন্য ভর্তি প্রক্রিয়া যথাসময়ে সম্পন্ন করার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এতে শিক্ষার্থীদের সঠিক সময়ে শিক্ষাজীবন শুরু করা এবং নির্ধারিত সময়মতো শিক্ষাবর্ষ সমাপ্ত করা সম্ভব হবে। যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী আবেদন করবে, তারা বিভাগীয় শহরে নিজেদের তত্ত্বাবধায়নে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের ভ্রমণজনিত ভোগান্তি দূর করতে পারে।

পরিশেষে গুচ্ছ পদ্ধতির কারণে সৃষ্ট জটিলতা ও সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে এ থেকে সরে আসা প্রয়োজন। বাংলাদেশে গুণগত মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট ও মানসম্মত ভর্তি প্রক্রিয়া, যা শিক্ষার্থীদের যোগ্যতার ভিত্তিতে গৃহীত হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বকীয়তা বজায় রাখবে।

লেখক, সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ